বাংলা- লেকচার-১৮ বাংলা ব্যাকরণ (বিস্তারিত)
Category: Bangla
Posted on: Wednesday, September 13, 2017
'ব্যাকরণ' শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে। এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ 'বিশ্লেষণ' (বি+আ+কৃ+অন) বিশেষ এবং সম্যকরূপে বিশ্লেষণ। চিকিৎসাবিদ মৃতদেহের অঙ্গ ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে মানবদেহের উপাদানসমূহ সম্বন্ধে যেরূপ সম্যক জ্ঞান লাভ করে থাকে, একইভাবে ব্যাকরণের মাধ্যমে ভাষার উপাদান, গঠন প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয় সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায়। অনেক ব্যাকরণবিদ ব্যাকরণকে ভাষার সংবিধান বলে অভিহিত করেছেন। ভাষার জন্ম নির্দিষ্ট দিনক্ষণ
তারিখে হয় না বটে কিন্তু একটি সুনিয়ন্ত্রি বির্বতণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ক্রমোন্নতির পথে ধাবিত হয়। ভাষার জন্মের অনেক পরে ব্যাকরণের জন্ম হলেও ব্যাকরণ এই সুনির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তনের বিধিমালা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করে থাকে। সে কারণেই ব্যাকরণ শাস্ত্র একটি বিজ্ঞান শাস্ত্র। ব্যাপক অর্থে একে ভাষাবিজ্ঞান বলে। ভাষাবিজ্ঞান ভাষার অভ্যন্তরীণ রীতি-নীতি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে।
■ব্যাকরণের সংঙ্গা
যে শাস্ত্র দিয়ে ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ (ধ্বনি, শব্দ ও বাক্য) বিশেষভাবে নির্ণয় করা যায় এবং ভাষার ব্যবহারকালে সেই নির্ণীয় তত্ত্ব ও তথ্য পড়ে আয়ত্ত করলে শুদ্ধভাবে লিখতে, পড়তে ও বলতে পাড়া যায়, তাকে ব্যাকরণ বলে। ব্যবহারকালে সঠিক সংজ্ঞা সম্পর্কে ভাষাবিজ্ঞানীগণও একমত হতে পারেননি। নিচে কতিপয় সংজ্ঞা প্রদান করা হলঃ
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, "যে শাস্ত্র কোন ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ, আকৃতি ও প্রয়োগনীতি বুঝিয়ে দেয়া হয়, সেই শাস্ত্রকে বলে সেই ভাষার ব্যাকরণ।"
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহের মতে, "যে শাস্ত্র কোন ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ, প্রকৃতি ও প্রয়োগের রীতি আলোচনা করা হয় এবং যার সাহায্যে সে ভাষা কথা ও লেখায় শুদ্ধরূপে প্রয়োগ করা যায়, সে শাস্ত্রকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে।
তিনি আরও বলেছেন, "যে শাস্ত্র জানলে ভাষা শুদ্ধরূপে লিখতে, পড়তে ও বলতে পারা যায় তার নাম ব্যাকরণ।"
ড. সুকুমার সেনের মতে, "যে শাস্ত্রে ভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতির বিচার ও বিশ্লেষণ আছে এবং যে শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে ভাষা শুদ্ধরূপে বলতে, লিখতে ও শিখতে পারা যায়, তাকে ভাষার ব্যাকরণ বলে।"
ড. এনামুল হকের মতে, "যে শাস্ত্র দ্বারা ভাষাকে বিশ্লেষণ করে এর বিবিধ অংশের পারস্পারিক সম্পর্ক নির্ণয় করা যায় এবং ভাষা রচনাকালে আবশ্যক মত সেই নির্ণীত তত্ত্ব ও তথ্য প্রয়োগ সম্ভবপর হয়ে ওঠে তার নাম ব্যাকরণ।"
ড. হুমায়ুন আজাদের মতে, "ব্যাকরণ বলতে বোঝায় এক শ্রেণীর ভাষা বিশ্লেষণাত্মক পুস্তক যাতে সন্নিবিষ্ট হয় বিশেষ বিশেষ ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগের সূত্রাবলী।"
মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর মতে, "যে শাস্ত্রে কোন ভাষার বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃতি ও স্বরূপের বিচার বিশ্লেষণ করা হয় এবং বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক নির্ণয় ও প্রয়োগবিধি বিশদভাবে আলোচিত হয়, তাকে ব্যাকরণ বলে।"
উপরিউক্ত পন্ডিতগণের মতামতের প্রেক্ষিতে বলা যায়, যে শাস্ত্র পাঠ করলে ভাষাকে বিশ্লেষণ করে এর বিভিন্ন উপাদানের স্বরূপ ও প্রকৃতি নির্ণয় করা যায়, এগুলোর কার্যাবলি ও ব্যবহার বিধি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় এবং ভাষা শুদ্ধরূপে বলতে, লিখতে ও পড়তে পারা যায়, তাকে ব্যাকরণ বলে।
■ বাংলা ব্যাকরণ
প্রতিটি ভাষারই নিজস্ব কিছু নিয়ম আছে। আর সেই নিয়মের উপর ভিত্তি করেই ব্যাকরণ রচিত হয়। বাংলা ব্যাকরণ বাংলা ভাষাকে বিশ্লেষণ করে। যে শাস্ত্র বাংলা ভাষাকে ব্যাকরণ বিশ্লেষণ করে তার প্রকৃতি ও প্রয়োগরীতি বুঝিয়ে দেওয়া যায় এবং যার সাহায্যে ভাষা শুদ্ধরূপে লিখতে, পড়তে ও বলতে পারা যায়, সেই শাস্ত্রকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন পন্ডিতগণ বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন-
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহের মতে, যে শাস্ত্র পড়লে বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে লিখতে ও বলতে পারা যায় তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, যে শাস্ত্রের সাহায্যে বাংলা ভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতি সব দিক দিয়ে আলোচনা করে বুঝতে পারা যায় তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
ড. সুকুমার সেনের মতে, যে শাস্ত্র বাংলা ভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতির বিচার-বিশ্লেষণ করে এবং যে শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে বাংলা ভাষা শুদ্ধরূপে লিখতে, বলতে ও পড়তে পারা যায় তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের মত, যে শাস্ত্র দ্বারা ভাষাকে বিশ্লেষণ করে এর বিভিন্ন অংশের পারস্পারিক সম্বন্ধ নির্ণয় করা যায় তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, যে শাস্ত্র পাঠ করলে বাংলা ভাষাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর স্বরূপ ও প্রকৃতি নির্ণয় করা যায় এবং বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে বুঝতে, শুদ্ধভাবে লিখতে, পড়তে ও বলতে পারা যায়, তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
■ বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশ
প্রাচীন কাল থেকেই এ উপমহাদেশের সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্য চলে আসছিল। ফলে সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের সৃষ্টি হয়ে থাকলেও বাংলা ভাষার ব্যাকরণ আলোচনার দিকে সে আমলের পন্ডিতগণ বিশেষ নজর দেননি। আঠার শতকের ত্রিশের দশকে ঢাকার ভাওয়ালে পর্তুগিজ পাদ্রী বাংলা ভাষার দি¦-ভাষিক অভিধান ও খন্ডিত ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। তখন থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষাগুচ্ছের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা ভাষার প্রতি পন্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় এবং এর বিশ্লেষণ শাস্ত্র রচনার কাজ শুরু হয়। এরপর প্রায় আড়াই'শ বছর ধরে ভাষাবিজ্ঞানীগণ বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছেন। তার উদ্ঘাটন করেছেন ভাষার রহস্যময় ইতিহাস, আবিষ্কার করেছেন বাংলা ভাষার ধ্বনি, শব্দ ও বাক্যের অসংখ্য সূত্র।
বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে একজন বিদেশী পর্তুগিজ পাদ্রী মনোএল দ্যা আস্সম্মসাও। আজ থেকে প্রায় ২৭১ বছর পূর্বে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন নগরীতে রোমান অক্ষরে এ ব্যাকরণ ছাপা হয়। এ বইয়ে তৎকালীন ঢাকা জেলার ভাওয়াল অঞ্চলের প্রচলিত বাংলা ভাষার কিঞ্চিৎ পরিচয় রয়েছে। এর পর ইংরেজি পন্ডিত নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড ১৭৭৮ সালে ইংরেজি ভাষার বাংলা ব্যাকরণ 'অ এৎধসসধৎ ড়ভ ঃযব ইধহমধষর খধহমঁধমব' বইটি রচনা করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ১৮০১ কেরি সাহেবের ব্যাকরণ; ১৮১৬ সালে গঙ্গা ভট্টাচার্যের ব্যাকরণ এবং ১৮২০ সালে কীথ সাহেবের ব্যাকরণ রচিত হয়।
১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে বাঙালিদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরণ লেখেন। তার মৃত্যুর পর ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা 'স্কুল বুক সোসাইটি' কর্তৃক 'গৌড়ীয় ব্যাকরণ' নামে এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। পরর্বতী সময়ে কয়েকজন ইংরেজি পন্ডিত ইংরেজি ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। পরে বাঙালি পন্ডিতগণ ব্যাকরণ রচনায় ব্রতী হন। এসব ব্যাকরণ ইংরেজি ও সংস্কৃত ব্যাকরণের আদর্শের সংমিশ্রণে প্রণীত হয়।
পরবর্তীকালে অনেকেই বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। তাদের মধ্যে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে অনেক পন্ডিত ব্যক্তি বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। বর্তমানে প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণ অনেকাংশে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আলোচিত হলেও বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার এখনও যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। যদিও অনেকেই ব্যাকরণের বিচিত্র সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, তথাপি বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে কোন শেষ সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব হয়নি। অবশ্য কোন ভাষার ব্যাকরণকেই সুনির্দিষ্ট সীমারেখায় আবদ্ধ করে রাখা যায় না। কারণ ভাষা নদীর প্রবাহের মতই গতিশীল। ভাষার পরিবর্তনশীলতার জন্য ব্যাকরণের নিয়ম-কানুনের পরিবর্তন ঘটে।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষার উন্নীত বাংলা ভাষা বর্তমানে বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী হয়ে উঠেছে এবং এর ফলে যুগোপযোগী ব্যাকরণ রচনারও প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে তাই বর্তমানে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আধুনিক ভাষাবিদগণও বাংলা ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
■ ব্যাকরণের বৈশিষ্ট্য
ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয় ভাষার ভেতরের নিয়ম-শৃঙ্খলা। ভাষায় বহুদিন ধরে যে প্রবাহ চলে আসছে তাতে ভাষার ধ্বনি ও ব্যবহারে এবং বাক্য গঠনের রীতিনীতিতে নানা পরিবর্তন সূচিত হতে হতে বর্তমানে প্রমাণ্য ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা রীতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যাকরণের এই রীতির সকল জ্ঞাতব্য বিষয় আলোচিত হয়। যুগে যুগে ভাষা পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমানে কি রূপ লাভ করেছে ব্যাকরণে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। ব্যাকরণ ভাষার অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলা আবিষ্কার করে। আর এভাবেই ব্যাকরণের মাধ্যমে ভাষার বিভিন্নমুখী বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।
ব্যাকরণকে ভাষার সংবিধান বলা হয়ে থাকে। সংবিধানে যেরূপ রাষ্ঠ্রীয় আইন-কানুনের সমাবেশ থাকে, তেমনি ব্যাকরণেও ভাষার যাবতীয় নিয়ম রীতি স্থান পায়। প্রয়োজনের তাগিদে যেরূপ রাষ্ঠ্রীয় সংবিধানের মাঝে মাঝে পরিবর্তন হয়, তেমনি ব্যাকরণের নিয়ম-কানুনও পরিবর্তিত হয়ে থাকে। কারণ ভাষা কখনও ব্যাকরণের অনুসরণ করে না বরং ব্যাকরণই ভাষার প্রয়োজনীয় ও পরিবর্তিত গতিপথের দিকে সর্তক দৃষ্টি রেখে নিজের নিয়ম-কানুনকেও সময়ের উপযোগী করে সংশোধন করে থাকে।
ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিষ্কার করাই ব্যাকরণের কাজ। যে ভাষা ব্যাকরণের কঠিন আইনের সীমা লঙ্ঘন করে বাইরে বের হতে পারে না, সে ভাষার বিকাশ সম্ভব হয় না। সংস্কৃত ভাষা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ব্যাকরণের কঠিন নিয়ম অনুসরণ করতে গিয়ে সংস্কৃত ভাষা আজ মৃতপ্রায়। অপরদিকে বাংলা ভাষা ব্যাকরণের কঠিন নিয়মের বেড়ায় আবদ্ধ না থেকে প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তিত গতিপথ অনুসরণ করে। অধুনিক যুগে বিশ্বের উন্নত সাহিত্যের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপনের ফলে বাংলা ভাষার সাহিত্যের গ্রহনযোগ্য যেসব আদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটেছে তাতে বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
ভাষার সৃষ্টি হয়েছে আগে, পরে ব্যাকরণ সৃষ্টি হয়েছে ভাষারই প্রয়োজনে। ভাষার বিভিন্ন নিয়ম-কানুনকে শ্রেণীবদ্ধ করে ব্যাকরণ তৈরী হয়েছে। এভাবে ভাষার একটা কাঠামো তেরী করে পরে এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনা করা হয়েছে। ভাষার রূপ কী হওয়া উচিত ব্যাকরণ সে নির্দেশ কখনও দেয় না বরং ভাষা কি নিয়মে চলছে তারই পর্যালোচনা করে মাত্র। সহজ কথায়, ভাষা যে নিয়মে অগ্রসর হচ্ছে ব্যাকরণ সে নিয়মের বিশ্লেষণের রশি ধরে এগিয়ে যায় মাত্র।
ব্যাকরণের এ বৈশিষ্ট্যের আলোকে দেখা যায় যে, ব্যাকরণ ভাষাকে শাসন করে না বরং ভাষা দ্বারাই ব্যাকরণ শাসিত হয়ে থাকে। ব্যাকরণের নিয়ম-কানুন শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়েছে শুধুমাত্র ভাষাকে যথেচ্ছাচার থেকে রক্ষা করার উদ্দেশে। এ জন্য যার যেমন ইচ্ছা ভাষাকে ব্যবহার করতে পারে না। ব্যাকরণের বিধিবদ্ধ নিয়ম-কানুন সকলেই মেনে চলতে হয়। অবশ্য ভাষার স্বাভাবিক গতি প্রবাহের ফলে নিয়ম-কানুনের যে পরিবর্তন ঘটে থাকে ব্যাকরণও তা অস্বীকার না করে মেনে নিয়ে থাকে। এর ফলে নতুন নতুন নিয়ম-কানুন ব্যাকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।
বাংলা ভাষার ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, প্রাচীনকালের বাংলা ভাষার যে রূপ ছিল আধুনিককালে তা পরিবর্তিত হয়ে অনেক দূরে সরে এসেছে। এ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে নদীর ¯্রােতের মত ভাষার স্বাভাবিক গতিতে চলার কারনেই। ব্যাকরণ ভাষার এ পরিবর্তন কখনও বাধ সাধে না।
■ ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা
ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক বলেন, "আলো, জল, বিদ্যুৎ, বাতাস প্রভৃতি সম্বন্ধীয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য না জানিয়াও মানুষ বাঁচিয়াছেন, বাঁচিতেছে ও বাঁচিবে। কিন্তু তাই বলিয়া ঐ সমস্ত বস্তুর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যকে মানুষ অস্বীকার করিয়া বর্তমান সভ্যতার গগন বিচুম্বী সৌধ নির্মাণ করিতে পারে না। ব্যাকরণ না জানিয়াও ভাষা চলিতে পারে; কিন্তু ভাষাগত সভ্যতা না হউক, অন্তত ভ্যবতার পত্তন বা সমৃদ্ধি হইতে পারে না। ব্যাকরণ না জানিলে ভাষাগত আদর্শ হইতে বিচ্যুত হতে হয় বলিয়া ভাষা উন্নত প্রকৃতির ভাবের বাহন হইয়া শীলতাসম্পন্ন সাহিত্যের সৃষ্টি করিতে পারে না। এই জন্যই শিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে ব্যাকরণ সম্বন্ধীয় সাধারণ জ্ঞানের সঙ্গে বিশেষ জ্ঞানও আবশ্যক।
কোন ভাষার অভ্যন্তরীন বৈশিষ্ট্য ও নিয়ম-শৃঙ্খলা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়ার জন্য 'ব্যাকরণ' পাঠের প্রয়োজনীয়তা একান্তভাবে অপরির্হায। ব্যাকরণ ভাষার যাবতীয় নিয়ম-কানুনের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে বলে ভাষাভাষী সকল আগ্রহশীল ব্যক্তিকে ব্যাকরণ পাঠ করতে হয়। ব্যাকরণের সঙ্গে সম্পর্ক না রেখেও ভাষা আয়ত্ত করা যায় সত্য, কিন্তু সুষ্ঠরূপে ভাষা প্রয়োগের জন্য ব্যাকরণ জ্ঞান অপরিহার্য। মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারে অতি পরিচয়। কিন্তু প্রয়োগের ব্যাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিচিতি যথেষ্ঠ নয়। ভাষার অভ্যন্তরীণ খুঁটিনাটি অবহিত হলে সার্থক প্রয়োগের ব্যাপক প্রসারতা আনয়ন সম্ভব। ব্যাকরণ এই ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ব্যাকরণ পাঠের ভাষা সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায়। বিশেষত লেখ্যভাষার স্বরূপ উপলদ্ধির জন্য পদ্ধতিগত শিক্ষা হিসেবে ব্যাকরণ অধ্যয়ন অপরিহার্য। ভাষার অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলা জানা থাকলে তার সুষ্ঠ ও সার্থক প্রয়োগও সম্ভব হয়। তাছাড়া ভাষার সৌন্দর্য সম্পাদনের রীতিনীতি (যেমন: ধ্বনি, শব্দ. ছন্দ, বাক্য, অলংকার, বাগধারা) ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়। সুতরাং একটি ভাষার সৌন্দর্য সম্ভোগের জন্যও সেই ভাষার ব্যাকরণ পাঠ অবশ্য কর্তব্য।
ব্যাকরণ সাহিত্য, সাহিত্যিক এবং সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রীদের ভাষা ব্যবহারে পরিমিতিবোধ ও সুসঙ্গতি আনয়ন করতে পুরোপুরিভাবে সাহায্য করে। তাই সাহিত্য রশিকের পক্ষে ব্যাকরণের জ্ঞান অর্জন খুবই প্রয়োজন।
তাছাড়া ভাষার প্রকৃতি, স্বরূপ, রীতিনীতি, ভাষায় শব্দের যথাযথ প্রয়োগে ভাষাকে গতিশীল ও প্রানবন্ত করে তোলান এবং ভাষাকে সুসংগত করে উন্নত সাহিত্য সৃষ্টির জন্য ব্যাকরণের জ্ঞান জরুরী। তাই ভাষাকে শুদ্ধভাবে লিখতে, বলতে ও পড়তে পারার জন্য ব্যাকরণের প্রয়োজন।
■ ব্যাকরণের প্রকারভেদ
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ব্যাকরণের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ করে ব্যাকরণকে চার শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যাকরণবিদগণ তাঁর এ শ্রেণীবিভাগকে গ্রহণ করেছেন। যেমন:
১. বর্ণনাত্মক ব্যাকরণঃ সাম্প্রতিককালের কোন একটি ভাষা রীতি ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে বর্ণনা প্রদানই এই জাতীয় ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয় এবং সেই বিশেষ কালের ভাষা যথাযথ ব্যবহার করাও এর লক্ষ্য।
২. ঐতিহাসিক ব্যাকরণঃ কোন নির্দিষ্ট যুগের ভাষাগত প্রয়োগরীতি আলোচনাপূর্বক আলোচ্য ভাষার প্রকৃত রূপটি উদ্ঘটনা ও বিকাশের ইতিহাশ পর্যালোচনা করাই এর লক্ষ্য।
৩. তুলনামূলক ব্যাকরণঃ এ শ্রেণীর ব্যাকরণ কোন বিশেষ কালের বিভিন্ন গঠন, প্রয়োগরীতি ইত্যাদি তুলনামূলক আলোচনা করে। অর্থাৎ কোন সুনির্দিষ্ট কালের বিশেষ একটি ভাষার প্রয়োগ রীতি আলোচনাকালে অন্য ভাষার প্রয়োগ ও রীতির সাথে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে প্রথমোক্তটির উৎপত্তি ও বিকাশের ঐতিহাসিক ধারাটি অনুসন্ধানই এর লক্ষ্য।
৪. দার্শনিক বিচারমূলক ব্যাকরণঃ ভাষার অর্ন্তনিহিত চিন্তা প্রনালীটি আবিষ্কার ও অবোলম্বন করে সাধারণভাবে কিংবা বিশেষভাবে ভাষা রূপের উৎপত্তি ও বিবর্তন ঘটে থাকে, তার বিচার করা এ পর্যায়ের ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়।
■ ব্যাকরণের কাঠামো
ব্যাকরণের কাঠামোর কথা ভাবতে হলে এর পরিধির কথা ভাবতে হয়। ব্যাকরণ তৈরী হয়েছে ভাষাকে কেন্দ্র করে। ভাষার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পূর্ণরূপ ফুটে ওঠে এক একটি বাক্যে। কতকগুলো বাক্য একসাথে ব্যবহৃত হয় একটি পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য প্রকাশ করে। একটি বাক্য বিশ্লেষণ করলেই তাই ভাষার বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে জানা যায়। একটি বাক্য বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় শব্দ, শব্দ বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় বর্ণ বা ধ্বনি। এই ধ্বনিই হচ্ছে ভাষার মূল উপাদান। ধ্বনির লিখিত রূপই হচ্ছে বর্ণ। আবার অন্য কথায়, বর্ণ বা ধ্বনি একত্রিত হয়ে সৃষ্টি হয় শব্দ। শব্দের সাথে বিভক্তিযুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় পদ। কতিপয় পদের সার্থক ব্যবহারের ফলে গড়ে ওঠে একটি সুন্দর বাক্য।
ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, ভাষার বিশ্লেষণে তিনটি স্তরের সন্ধান মেলে; যেমন: ক. ধ্বনি বা বর্ণ, খ. শব্দ ও পদ এবং গ.বাক্য। ব্যাকরণের কাঠামো তাই এই তিনটি স্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ধ্বনি বা বর্ণের আলোচনাকে বলা হয় ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দ ও পদের আলোচনাকে বলা হয় শব্দতত্ত্ব বা রূপতত্ত্ব এবং বাক্যের আলোচনাকে বলা হয় বাক্যতত্ত্ব।
ব্যাকরণের কাঠামো সম্পর্কে বিভিন্ন পন্ডিতগণ একমত হতে পারেনি। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ব্যাকরণকে প্রধানত পাঁচ ভাগে বা প্রকরণে ভাগ করেছেন; যেমন: ক. ধ্বনি প্রকরণ, খ. শব্দ প্রকরণ, গ. বাক্য প্রকরণ, ঘ. ছন্দ প্রকরণ ও ঙ. অলংকার প্রকরণ।
অন্যদিকে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ব্যাকরণের কাঠামো নির্ণয় করেছেন এভাবে- ক. বর্ণ ও ধ্বনি (ধ্বনিতত্ত্ব), খ. পদ, গ. শব্দ (রূপতত্ত্ব) এবং ঘ. বাক্যতত্ত্ব (বাক্য রীতি বা বাক্য বিশ্লেষণের অন্তর্গত)। এর সঙ্গে তিনি ছন্দ ও অলংকারকেও ব্যাকরণের সীমানায় স্থান দিতে কুন্ঠিত হননি।
ড. মুহাম্মদ এনামুল হক ব্যাকরণকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছেন; যেমন: ক. বর্ণ ও ধ্বনি প্রকরণ, খ. শব্দ প্রকরণ, গ. পদ প্রকরণ, ঘ. বাক্য প্রকরণ ও ঙ. ছন্দ প্রকরণ।
পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাষাতত্ত্ববিদগণ বিভিন্নভাবে ব্যাকরণের কাঠামো নির্দেশ করেছেন। যেমন:
১. ধ্বনি প্রকরন বা ধ্বনিতত্ত্বঃ এ অংশে ধ্বনি, ধ্বনির উচ্চারণ, ধ্বনির বিন্যাস, ধ্বনির পরিবর্তন, বর্ণ, সন্ধি, ণত্ব বিধান, ষত্ব বিধান প্রভৃতি ধ্বনি সম্বন্ধীয় ব্যাকরণের বিষয়গুলো আলোচিত হয়।
২. শব্দ প্রকরণ ও রূপতত্ত্বঃ শব্দ, শব্দের প্রকার, শব্দের গঠন, পদ, পদের পরিচয়, পদের শ্রেণীবিভাগ, পদ পরিবর্তন, উপসর্গ, অনুসর্গ, কারক, বিভক্তি, লিঙ্গ, বচন, ধাতু, শব্দরূপ, সমাস, প্রকৃতি-প্রত্যয়, ক্রিয়া প্রকরণ, ক্রিয়ার কাল, ক্রিয়ার ভাব, শব্দের ব্যুৎপত্তি ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা শব্দ প্রকরণের বা রূপতত্ত্ব করা হয়।
৩. বাক্য প্রকরণ বা বাক্যতত্ত্বঃ বাক্য, বাক্যের অংশ, বাক্যের প্রকার, বাক্যের বিশ্লেষণ, বাক্য পরিবর্তন, পদক্রম, বাগধারা ও বাগবিধি, বাক্য-বিশ্লেষণ রীতি, বাক্য সংকোচন, বাক্য সংযোজন, বাক্য বিয়োজন, যতিচিহ্ন বা বিরামচিহ্ন প্রভৃতি বিষয় বাক্য প্রকরণ বা বাক্যতত্ত্বে আলোচিত হয়।
৪. ছন্দ ও অলংকার প্রকরণঃ এ অংশে ছন্দ, ছন্দের সংঙ্গা, ছন্দের প্রকার, ছন্দের নিয়মাবলী, অলংকার, অলংকারের প্রয়োগ, অলংকারের প্রয়োজনীয়তা ও শ্রেণীবিন্যাস আলোচিত হয়।
৫. অর্থতত্ত্বঃ এ অংশে শব্দের অর্থবিচার, বাক্যের অর্থবিচার, অর্থের বিভিন্ন প্রকারভেদ (মুখ্যার্থে, গৌণার্থে, বিপরীতার্থে) আলোচিত হয়।
কাজখুঁজি ডট কম এ রেজিষ্ট্রেশন করুন
কাজখুঁজি ডট কম এ রেজিষ্ট্রেশন করলে আপনি এর সকল ফিচার ব্যবহার করতে পারবেন। এটি সম্পূর্ন ফ্রি!
Join as Candidate
ক্যান্ডিডেট হিসেবে জয়েন করে যা যা করতে পারবেন:
১. আপনার সিভি/রিজিউম আপডেট করতে পারবেন এবং অনলাইনের জব পোষ্টিংগুলিতে আবেদন করতে পারবেন।
Join as Candidate > From Candidate Menu: goto Resume & Jobs > Edit resume
২. আপনার পাবলিক প্রোফাইল তৈরি করতে পারবেন । এখান থেকে যে কেউ আপনাকে সহজে খুঁজে পাবে এবং আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে
Join as candidate > goto your candidate dashboard > Create your public profile
From your candidate dashboard edit your public profile and you are done.
Click here to access public profiles
Featured Articles
Resume Structure for Government Jobs
Resume/CV
আইবিএ এবং কিকি বই পড়তে হবে: আইবিএর ডিগ্রী যদি হয় আপনার স্বপ্ন, তাহলে প্রস্তুতি শুরু করুন এখনই
Career Guide
জেনেনিন কি বোর্ড এর F1 থেকে F12 পর্যন্ত বাটন গুলোর কাজ
Computer and IT
বিভিন্ন শাস্ত্রের জনক (Father of Various Subjects)
International
ব্যাংক ভাইভা টার্ম (Bank viva Terms)
Bank
সরকারী চাকুরিতে আবেদনের বিভিন্ন নমুনা ফরম
Resume/CV
BCS Cadre Choice-বিসিএস পরীক্ষায় ক্যাডার চয়েসঃ সুজন দেবনাথের জানালায়
BCS